দেশের অর্থনীতির ওপর করোনা মহামারি যে কালো ছায়া ফেলছে তা থেকে খানিকটা উদ্ধার পাওয়ার জন্য এ মুহূর্তে বহু মানুষ তাকিয়ে আছেন। কিন্তু রাজস্ব আয়ের যে অবস্থা তাতে বাজেটের মাধ্যমে কতটুকু সামাল দেওয়া যাবে-তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। আবার চলমান করোনার ধাক্কা সামলাতে আগামী দিনগুলোতে আরও ব্যয় বাড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মতে, এ সময়ে ঋণ করে হলেও ব্যয় করতে হবে। সামাল দিতে হবে পরিস্থিতি। ফলে দেশে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের ঘাটতি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট।
এ বিশাল ঘাটতি এবং রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে আজ আগামী বছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন তিনি। এটি অর্থমন্ত্রীর জন্য তৃতীয় বাজেট। নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মোট আয় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী বাজেটে পুরোনো শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি নতুন শিল্প স্থাপনে নানা কর ছাড় দেওয়া হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ থেকে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কমানো হচ্ছে। এটি দেড় কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এক কোটি টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকে রেয়াতযোগ্য হিসাবে গণ্য করা হবে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ বাজেট নিঃসন্দেহে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে না। বাজেটে আশা ও আশঙ্কার কথা বলতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ, কৃষি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। এসব দিক বিবেচনা করে সম্প্রসারণমূলক বাজেট দিতে হবে। তবে আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে রাজস্ব খাত নিয়ে। প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় সে তুলনায় আদায় হয় না। এ জন্য কিছুটা হলেও উচ্চাভিলাষী ও প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং দুর্নীতি দায়ী। এদিকে নজর দিতে হবে। যেভাবে টাকা আসবে : করোনার ধাক্কা সামলাতে সরকার আয়ের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। সব মিলে এ করোনাকালীন ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি জিডিপির ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর মোট আয়ের মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে কর খাত থেকে আসবে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা, কর ব্যতীত প্রাপ্তি হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। তবে করের টাকা দুটি খাত থেকে আদায় করা হয়। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত কর ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আগামী বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
টাকা ব্যয় হবে যেভাবে : আগামী বাজেটে সরকারের মোট ব্যয়ের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫শ কোটি টাকা, উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা, ঋণ ও অগ্রিম ৪ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা এবং খাদ্য সহায়তা খাতে ৫৯৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
তবে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হচ্ছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটানো হবে যেভাবে : নতুন বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ (অনুদানসহ) ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা এবং অনুদান ছাড়া ঘাটতি হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী বাজেটে ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক খাত থেকে নেওয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
তবে অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। পাশাপাশি ঋণ করার কারণে বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এজন্য আগামী বছরে সুদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে আসন্ন বাজেটে। এবারই প্রথম দেশের ১৫০টি উপজেলার সব বয়স্ক ও বিধবা নারীকে ভাতা দেওয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বাড়বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাও। বর্তমানে ১২ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পাচ্ছেন। জুলাই থেকে প্রতি মাসে এটি ২০ হাজার টাকা হবে। সবমিলে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।
স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অপরিবর্তিত থাকছে মার্চেন্ট ব্যাংক; সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত মোবাইল ফোন কোম্পানির কর হার। এছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তি মালিকানাধীন (প্রোপ্রাইটারশিপ) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেনের ওপর ন্যূনতম আয়কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম ৩ বছর ন্যূনতম কর হার দশমিক ১০ শতাংশ থাকছে। তবে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ এবং তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর হার ১ শতাংশ বহাল থাকছে।
আগামী অর্থবছরে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির কর ২৫ শতাংশ, এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং ফ্রিজের ক্ষেত্রে এ মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি ১৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
আগাম কর (এটি) হার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। বিভাগীয় শহর ব্যতীত অন্য জেলায় ২০০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট সাধারণ হাসপাতাল নির্মাণ করলে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া যাবে।
আগামী বাজেটে পণ্য আমদানিতে অগ্রিম আয়করে (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স বা এআইটি) বড় পরিবর্তন আসছে। চার স্তরের পরিবর্তে ৬ স্তরে এআইটি আদায় করা হবে। সর্বোচ্চ হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। স্থানীয় শিল্পকে সহায়তা দিতে কাঁচামালের কর কমানো হচ্ছে। অগ্রিম আয়কর ০, ১, ২, ৩, ৫, ২০ শতাংশ হারে আদায় করা হবে। এর বাইরে চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, মটরডাল, সব ধরনের ডাল, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ভুট্টা, আটা-ময়দা, লবণ, পরিশোধিত তেল, চিনি, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতাসহ সব ধরনের ফল সরবরাহের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্যের ওপর ২ শতাংশ হারে উৎসে কর বহাল থাকছে।
স্থানীয় শিল্পের চলার পথ মসৃণ করতে আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের ওপর আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়। এছাড়া ভ্যাট আইনে কাঠামোগত বড় পরিবর্তন আসছে। আইনটি আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (অ্যাডভান্স ট্যাক্স বা এটি) হার কমানো হচ্ছে। বাড়বে সম্পদশালীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ে হারও। এ লক্ষ্যে সারচার্জ (সম্পদ কর) বাড়ানো হচ্ছে। ন্যূনতম সারচার্জ বাতিল করে স্ল্যাব পুনর্গঠন করা হবে।
করোনার প্রভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। করোনার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধিও কাটছাঁট করা হয়েছে। শুরুতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হলেও সম্প্রতি তা কমিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশের ঘরে আনা হয়। তবে চলতি বছরের ন্যায় এবারও মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
আগামী বাজেটে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় অগ্রাধিকার খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করাই হবে প্রধান অগ্রাধিকার। এজন্য স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আগামী বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকছে। এ ছাড়া আগামী বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।